রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:০১ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
মানুষ সামাজিক জীব। এ কারণে সমাজে বসবাস ও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন, অনুরাগী কিংবা শত্রুসবার সঙ্গে ওঠা-বসা করতে হয়। মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ সমাজে চলাফেরার বড় উপায়। মানুষের মন জয় করে জীবন পরিচালনা করলে পারস্পরিক সৌহার্দ্যবোধ বাড়ে, প্রীতিময় সমাজ গড়ে ওঠে। সহজে মানুষের মন জয়ের যত উপায়-উপকরণ কিংবা কৌশল থাকুক না কেন, উত্তম ও অমায়িক ব্যবহার সবার ঊর্ধ্বে। অমায়িক ব্যবহার হলো সব ধরনের রূঢ় ও কঠোর ব্যবহার পরিহার করে কোমল ও নম্র আচরণ করা, যার মাধ্যমে প্রাণের শত্রুও বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অমায়িক ব্যবহারের জন্য বলেছেন। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর অনুগ্রহে আপনি তাদের প্রতি কোমল হৃদয়ের হয়েছিলেন।’ -সুরা আল ইমরান : ১৫৯
অমায়িক ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করেই বিপদে-আপদে সবাইকে কাছে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি তারা, তোমাদের মধ্যে যাদের চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর। যারা অমায়িক (সহজ-সরল), তারা সম্প্রীতির বন্ধনে সহজে আবদ্ধ হয়। আর তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে অপ্রিয় ব্যক্তি তারা, যারা চোগলখোরি করে, বন্ধুত্বের মাঝে বিচ্ছিন্নতা ঘটায় এবং নির্দোষ লোকদের মাঝে দোষ খুঁজে বেড়ায়।’ মিশকাত
অমায়িক ব্যবহার মানে হলো গর্ব-অহংকার না করা, রূঢ় আচরণ না করা। ব্যবহারে রূঢ়, গর্ব ও অহংকারীদের আল্লাহতায়ালা ভালোবাসেন না। ভালোবাসেন না যারা মানুষকে অবজ্ঞা-অবহেলা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। পবিত্র কোরআনের সুরা লোকমানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘অহংকারের বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করো না। কারণ আল্লাহতায়ালা কোনো উদ্ধত, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ সুরা লোকমান : ১৮
যারা জীবনে সফল হতে চায়, তাদের ব্যবহার সুন্দর করা বাঞ্ছনীয়। অমায়িক ব্যবহারের মাধ্যমে যা সহজে অর্জন করা যায়, খারাপ আচরণের দ্বারা তা অর্জন করা যায় না। নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নরম স্বভাব হতে বঞ্চিত সে সব ধরনের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।’ সুনানে আবু দাউদ : ৪৭৩৪
এটা সহজেই বলা যেতে পারে, যখন ব্যক্তি অমায়িক ব্যবহার উপেক্ষা করে রূঢ় আচরণ করে, তখন সে যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে। কল্যাণ হতে বঞ্চিত কেউ সফল হতে পারে না। তাই সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করে ব্যক্তির ব্যবহারের ওপর। যারা দুনিয়াতে মানুষ নিয়ে কাজ করতে চায় অর্থাৎ মানবতার পেছনে নিবেদিত হয়ে সময় দেয়, অনুপ্রেরণা দেয়, সঠিক পথ দেখায়, এক কথায় যারা ধর্মীয় প্রচারক তাদের সফলতার পেছনের গল্প হলো তারা ব্যবহারে অমায়িক। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা রহমানের বান্দা তারা জমিনে অত্যন্ত বিনম্রভাবে চলাফেরা করে। আর যখন জাহেল ব্যক্তিরা অশালীন ভাষায় সম্বোধন করে তখন তারা বলে সালাম।’ সুরা ফুরকান : ৬৩
মহান আল্লাহ কোমল, তিনি কোমলতাকে ভালোবাসেন। এটা হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শ্রেষ্ঠতম গুণ। উম্মত হিসেবে আমাদের এ গুণ হাসিল করতে হবে। অফিস-আদালত থেকে শুরু করে নিজের কর্মস্থল, নানা সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে কাজের সঙ্গী সবার সঙ্গে কোমল আচরণ করতে হবে। সবসময় কাছাকাছি থাকা মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের বিষয়ে পবিত্র কোরআনের সুরা নিসার ৩৬ নম্বর আয়াতে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গীসাথী, মুসাফির ও অধিকারভুক্ত দাস-দাসী। দাস-দাসীদের সঙ্গে সৎ ব্যবহারের ব্যাপারে কোরআন-হাদিসে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদিও এখন দাস-দাসী প্রথার প্রচলন নেই। তবে বর্তমানে অধীনস্থ কর্মচারী ও সহকর্মীদের সঙ্গে চরম উদ্ধত আচরণের মাধ্যমে কাজ আদায় করার হীন মানসিকতা বিরাজমান। এই আচরণ পরিহার করে উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে কাজ আদায় করে নেওয়া সফল ব্যবস্থাপকের কাজ। তারা মালিক কর্মকর্তাদের যেন শাসকশ্রেণি মনে না করে এজন্য সদা হাস্যোজ্জ্বল ও উত্তম ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজই শুধু নয়, বরং সফল ও বিজয়ীর বৈশিষ্ট্য।
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবিদের অমায়িক ব্যবহার আমাদের বিমোহিত করে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো কাউকে কষ্ট দেননি; বরং ইহুদিরা তার মৃত্যু কামনা করলেও তিনি উত্তমভাবে তার জবাব দিয়েছেন। হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) জিহাদ ছাড়া কখনো কাউকে স্বীয় হাত দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে প্রহার করেননি এবং দাস-দাসী বা স্ত্রীদেরও প্রহার করেননি।’সহিহ মুসলিম : ৬১৯৫
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গেও ভালো ব্যবহারের কথা বলেছেন। নবী কারিম (সা.) ব্যবহারের ক্ষেত্রে পৃথিবীতে শত্রু-মিত্র, ধনী-গরিব, কাছের-দূরের সবার সঙ্গে ছিলেন অমায়িক। তাইতো তাকে হত্যা করতে এসে ইসলাম গ্রহণ করার ঘটনা ঘটেছে। আবার তার ব্যবহারিক জীবন দেখে হজরত জায়েদ ইবনে হারিসা (রা.) পিতা ও চাচাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট থেকে যাবেন বলে।
আমরা যতই জ্ঞানার্জন করি না কেন, যত গুণের অধিকারীই হই না কেন অমায়িক ব্যবহারের মতো মহৎ গুণ অর্জন করা সব কাজের চেয়ে বেশি গুরুত্বের। কিছু মহৎগুণের মাধ্যমেই জয় করা যায় মানুষের মন। সেই মহৎ গুণ এমনিতেই অর্জন হয় না, এ জন্য প্রচেষ্টা থাকতে হয়। ব্যক্তির উত্তম চরিত্রের গুণে গুণান্বিত হওয়া যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি তার সঙ্গে মিষ্টভাষী, ধৈর্যশীল, সদালাপি, কোমল স্বভাবসম্পন্ন এবং সব কাজের সহজ সমাধান দিতে পারার যোগ্যতাও খুবই প্রয়োজনীয়। আর অমায়িক ব্যবহারের মাঝে রয়েছে এসব গুণ। আমরা প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রস্তুত করছি সকলের কাছে আকর্ষণীয় করতে, কিন্তু বাস্তব জীবনে কিংবা কর্মক্ষেত্রে হেরে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। ব্যবহার হয়ে উঠছে সবার কাছে অপছন্দনীয়। এ কারণে হচ্ছে ব্যক্তির সমালোচনা। এ সমস্যার সমাধানের পথ তালাশে আত্মসমালোচনার বিকল্প নেই। আবার আত্মসমালোচনায় হাজার ভুল ধরা পড়লেও একান্ত সূক্ষ্ম কিছু ভুল হয়তো নিজের অগোচরেই থেকে যাচ্ছে। যাতে নষ্ট হচ্ছে কাক্সিক্ষত পরিবেশ। চারিত্রিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতায় আমরা হয়ে উঠতে পারি একেকজন পৃথিবী সেরা বিজয়ী। আর এই বিজয় অর্জনের একমাত্র হাতিয়ার হলো অমায়িক ব্যবহার।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক